ব্যবসায়ী স্তরের ভ্যাট নিয়ে কিছু কথা

ভ্যাট আরোপিত হয় পণ্য ও সেবার ওপর, বিক্রির সময়ে। পণ্যের ক্ষেত্রে ৩টি স্তর রয়েছে। এর একটি হলো ব্যবসায়ী স্তর। ব্যবসায়ী স্তরের ভ্যাটের স্থানগুলো হলো, সুপারশপ, শপিং মল, জেনারেল স্টোর, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সেলস সেন্টার, ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার, ডিপো, ডিলার, পাইকারী বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা ইত্যাদি।

ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে কোন্ ব্যবসায়ী ভ্যাটমুক্ত এবং কোন্ ব্যবসায়ীকে ভ্যাট দিতে হবে এ বিষয়টা এখনও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। আজ আমি মূলত এ বিষয়টা স্পষ্ট করবো, ইন-শা-আল্লাহ।

সাধারণ কথা হলো, ব্যবসায়ী ৫% ভ্যাট দিলে রেয়াত পাবেন না, আর, ১৫% ভ্যাট দিলে রেয়াত পাবেন। সাধারণ আদেশ নং-১৭/মূসক/২০১৯, তারিখ: ১৭ জুলাই, ২০১৯ অনুসারে, সুপারশপ এবং শপিংমল দেশের যেখানেই অবস্থিত হোক এবং বিক্রির পরিমাণ যা-ই হোক না কেনো ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। উক্ত আদেশের টেবিল-৩ এর পণ্য সেখানেই বিক্রি হোক, আর বিক্রির পরিমাণ যা-ই হোক না কেনো ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।

সে পণ্যগুলো হলো, সিমেন্ট, সিরামিক ও পোরসেলিনের তৈরি পণ্য, জিপি শীট/সিআই শীট, এমএস প্রোডাক্ট, সেনিটারী ওয়্যার, এ্যালুমিনিয়াম ফিটিংস, এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশনসহ সকল প্রকার ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য।

উপরে বর্ণিত ৩ ক্যাটাগরির ব্যবসায়ীকে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে, তার অবস্থান যেখানেই হোক আর বিক্রির পরিমাণ যা-ই হোক না কেনো। এই ৩ ক্যাটাগরির বাইরে যেসব ব্যবসায়ী রয়েছেন তাঁদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকা হলে তারা ভ্যাটমুক্ত হবে।

বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে টার্নওভার কর প্রদান করবে নাকি ভ্যাট প্রদান করবে তা স্পষ্ট নয়। তবে, এ নিয়ে বিতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন। কারণ টার্নওভার কর ৪% আর ভ্যাট ৫%, তেমন পার্থক্য নেই। ‍

তবে, বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করার কোন সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি এখনো পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে প্রচলিত হয়নি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকা কি-না তা নির্ধারণ করার জন্য সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি প্রচলন করা দরকার।

তাহলে দাঁড়ালো এই যে, উপরে বর্ণিত সুপারশপ, শপিংমল এবং টেবিল-৩ এর পণ্যসমূহের বিক্রেতার অবস্থান যেখানেই হোক এবং বিক্রির পরিমাণ যা-ই হোক না কেনো, তাকে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।

অন্যান্য ব্যবসায়ীদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকা বা তার চেয়ে কম হলে ভ্যাটমুক্ত হবে। অন্যান্য ব্যবসায়ীদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লক্ষ টাকার বেশি হলে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।

ব্যবসায়ী স্তরে রেয়াত নিলে ভ্যাটের ভার কম হয়। কিন্তু বাস্তবে অল্প কিছু ব্যবসায়ী রেয়াত নেয়। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী রেয়াত নেয় না। এখন রেয়াত আলোচনা করি। রেয়াত হলো, আপনি পণ্যটা কেনার সময় যে ভ্যাট পরিশোধ করেছেন, সেই ভ্যাট ফেরৎ নিয়ে নেয়া। আপনি যদি পণ্যটা বিক্রি করার সময় ১৫% ভ্যাট পরিশোধ করেন, তাহলে রেয়াত নিতে পারবেন।

ধরুন, একজন ব্যবসায়ী উৎপাদনকারীর কাছ থেকে ৪০ টাকা দিয়ে একটা সাবান কেনেন। ৪০ টাকার উপর ৬ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যবসায়ী তাঁর দাখিলপত্রের মাধ্যমে ৬ টাকা নিয়ে নেবেন। ধরুন, তিনি সাবানটি ৫৫ টাকায় বিক্রি করবেন। ৫৫ টাকার ওপর ১৫% হারে ৮.২৫ টাকা ভ্যাট তিনি ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে সরকারকে পরিশোধ করবেন।

আগের ভ্যাট ৬ টাকা তিনি রেয়াত নিয়েছেন। তাহলে এক্ষেত্রে ভ্যাট দেয়া হলো ২.২৫ টাকা। রেয়াত না নিয়ে ৫% ট্রেড ভ্যাট পরিশোধ করলে ৫৫ টাকার ওপর ভ্যাট হতো ২.৭৫ টাকা এবং পূর্বের ৬ টাকা রেয়াত পাওয়া যেতো না। অর্থাৎ ৬+২.৭৫=৮.৭৫ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করতে হতো। তাই, বড় এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য রেয়াত নিয়ে ১৫% ভ্যাট পরিশোধ করা উত্তম।

ব্যবসায়ী স্তরে রেয়াত নিলে ভ্যাটের ভার কম হয়। প্রশ্ন আসে যে, রেয়াত কিভাবে নিতে হবে? রেয়াত নিতে হলে কিছু ডকুমেন্ট রাখতে হয়। যেমন: ক্রয়ের দলিল তথা ভ্যাট চালান, ক্রয় হিসাব রেজিষ্টার, বিক্রয় হিসাব রেজিষ্টার, ভ্যাট চালান ইস্যু করতে হয়, দাখিলপত্র দাখিল করতে হয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দলিলাদি সংরক্ষণ করতে হয়।

যারা একটু বড় প্রতিষ্ঠান তারা ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারে। এনবিআর ইএফডি-এসডিসি মেশিন দিচ্ছে। এই মেশিনে সব হিসাব থাকে। আলাদা হিসাব রাখতে হয় না। তাই, ইএফডি-এসডিসি নিতে পারেন। যেসব ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর অল্প কিছু পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন, তাদের হিসাবপত্রের পরিমাণ কম। তাই, রেজিষ্টারে হাতে লিখে এমন হিসাব রাখা যায়।

তবে, এজন্য পেশাদারের সাহায্য নিতে হবে। নিজে নিজে করা সহজ হবে না। আজকাল নেটে অনেক ভ্যাট পেশাদার পাওয়া যায়। তাছাড়া, দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেখানেও পাওয়া যায়। যেমন: বাংলাদেশ ভ্যাট প্রফেশনালস ফোরম (ভ্যাট ফোরাম), ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাট ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (আইভিটিআই), ভ্যাট কনসালট্যান্ট এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ভ্যাট বার এ্যাসোসেয়েশন, কর্পোরেট একাডেমী, বাংলাদেশ ট্যাক্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এমন আরো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রেনিং দেয়া হয়, পরামর্শ দেয়া হয়। দয়া করে যোগাযোগ করতে পারেন। আসুন আমরা ভ্যাটে রেয়াত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করি, ভ্যাটের ভার কমায় এবং উত্তম ভ্যাট ব্যবস্থা গড়ে তুলি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top